শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:২৪ অপরাহ্ন

আমার লক্ষীপুর গ্রামের উন্নয়ন কত দূর?

আমার লক্ষীপুর গ্রামের উন্নয়ন কত দূর?

ওসমান এহতেসাম
গ্রামকে ভালোবাসে না এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া মুশকিল; সবাই গ্রামকে ভালোবাসে। কারণ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল অফুরন্ত সৌন্দর্যে ভরপুর এক অপরূপ লীলাভূমি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সবুজ শ্যামলিমায় শোভিত আমাদের গ্রামাঞ্চলগুলো। গ্রামের সবুজ প্রকৃতি যেকোনাে মানুষের হৃদয়কে প্রশান্তিতে ভরে দেয়। গ্রামের শান্ত পরিবেশ মানুষের সকল ক্লান্তি দূর করে। তাই গ্রামকেই বলা হয় এদেশের প্রাণ।অনেক শহুরে মানুষ জীবনে খুব কম সময়ের জন্য গ্রামে যাওয়ার সুযােগ পান, তাদের কাছে গ্রামের রাস্তায় ঘােরার আনন্দই আলাদা। গ্রাম্য অঞ্চলের একটা নিজস্ব রূপ আছে। এখানে ঘুরে বেড়ালে ব্যস্ত শহরের একঘেয়েমি ভাবকে কাটিয়ে ওঠা যায়। এই পথ চলার মাধ্যমে আমরা সমস্ত রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভােগ করার সুযােগ পাই। দীগন্ত বিস্তৃত সবুজ গাছের আলােড়ন, বৃহৎ মাঠ, কৃষকদের ভূমি কর্ষণ, গ্রাম্য মহিলাদের জীবনযাপন, উন্মুক্ত মাঠে কোন গ্রাম্য ব্যক্তির গাওয়া লােকগীতি, গরু, মহিষ ও ষাঁড়ের গলায় বাঁধা ঘন্টার টুং টুং শব্দ প্রভৃতি দৃশ্য আমাদের মনে আনন্দের সঞ্চার করে।

তাছাড়া গ্রামে গেলে যে সতেজ এবং ঠাণ্ডা বাতাস আমরা পাই তা কোন শহরে পাওয়া অসম্ভব। শহরের ধোঁয়া এবং ধূলাে পরিপূর্ণ পরিবেশ আমাদের জীবনকে অসহ্য করে তােলে। শহরের এই কৃত্রিম জীবনের সাথে গ্রামের শান্ত, সুন্দর জীবনকে কখনই তুলনা করা যায় না। ফুটন্ত ফুল, সবুজ গাছ এবং মেয়ের মাথায় করে বােঝা বহন করার দৃশ্য শুধুমাত্র গ্রামের পথেই দেখা সম্ভব। তাইতো কবি আহসান হাবীব গ্রামের সৌন্দর্য ও রুপের কথা বলতে গিয়ে তার স্বরচিত ছড়ায় লিখেছেন, আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন/ মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন।/সোনার সবুজ আনে সোনালী প্রভাত/পাখির কাকলি শুনে কেটে যায় রাত।’
কবি আহসান হাবীবের মতো আমারও একটি গ্রাম আছে। কবিদের কবিতার মতো আমার গ্রামটিও ছবির মতাে সুন্দর। নাম লক্ষীপুর।আম-জাম, কাঁঠাল-লিচু, নারিকেল-সুপারি, শিমুল-পলাশ, তাল-তমাল আর নানাজাতের গাছপালায় সুসজ্জিত এই গ্রামটি কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার ১৬ নং ধামঘর ইউনিয়নে অবস্থিত। পাখপাখালির কলকূজনে সব সময়ই মুখর থাকে গ্রামখানি। শিশু-কিশোদের খেলার জন্য রয়েছে সুবিশাল মাঠ। এটি লক্ষীপুর মাঠ হিসেবে বেশ পরিচিত। এখানে কেবল গ্রামের শিশু-কিশোরাই খেলে না, এই মাঠে খেলতে আসে কুমিল্লার নানা উপজেলার লোকজন। এমনকি ফুটবল ও ক্রিকেটের বড় বড় টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয় এই মাঠে। এই টুর্নামেন্টের খেলায় অংশ গ্রহণ করে বাংলাদেশের জাতীয় ক্লাবগুলোর অনেক নামিদামি খেলোয়ারসহ নাইজেরিয়ার মতো বিদেশি তারকা খেলোয়ারও। আমার মনে হয়, শুধু কুমিল্লা নয়, সারা বাংলাদেশে এত বড় মাঠ খুব কমই আছে। মুরাদনগর উপজেলায় এটিকেই সবচেয়ে বড় মাঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কাজেই দেশ ছাড়িয়ে বিদেশিদের কাছেও এই মাঠের জনপ্রিয়তা অত্যধিক। দিনের পর দিন এই মাঠের চাহিদা যেন বেড়েই চলছে। তাই চাহিদার উপর নির্ভর করে আংশিক সংস্কার করে এই মাঠের নামকরণ করা হয় লক্ষীপুর মিনি স্টেডিয়াম। যদিও এতে আমি খুশি হতে পারিনি। কারণ ঐতিহ্যবাহী যে মাঠের কারণে আমার প্রাণের লক্ষীপুর গ্রাম আজ পরিচিত, যে মাঠ গ্রামের পরিচয়কে করেছ উজ্জ্বল ; সে মাঠের নামের আগে কেন ‘মিনি’ শব্দ প্রয়োগ করতে হবে। মিনি শব্দটি বাদ দিয়ে লক্ষীপুর স্টেডিয়ামও নামকরণ করা যেতে পারতো। এতে গ্রামের মর্যাদা ও ঐতিহ্য বহুগুণ বাড়তো বলে মনে করি। যাই হোক, এই মাঠ নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি, তাতেই খুশি।
লক্ষীপুরের সৌন্দর্য মাঠেই সীমাবদ্ধ, এমনটা নয়। এই গ্রামের এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে দারোগার খাল। খালের দু’পাশের প্রাকৃতিক শােভা এ গ্রামকে অপূর্ব সৌন্দর্য দান করেছে। দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ, ধান-কাউনের হাতছানি, নিঝুম দুপুরে বটের ছায়ায় রাখালের বাঁশি উদাস করে মনপ্রাণ। দিঘী-ডােবা, বিল-ঝিল- কী এক অপূর্ব সৌন্দর্যের সঞ্চয়!
তবে একটা সময় চারিদিকে ‘হাহাকার’ ছিল। শহর থেকে গ্রাম, পাড়া থেকে মহল্লা শুধু নেই আর নেই আওয়াজ ধ্বনিত হতো। খাবার নেই, বাসস্থান নেই, বিদ্যুৎ নেই, রাস্তা-ঘাট নেই, চিকিৎসা নেই, কর্মসংস্থান নেই। তবে আওয়ামী লীগের হাত ধরে দেশ এখন বদলে গেছে। যেদিকে তাকাই শুধু উন্নয়নের আলোর ঝলকানি। যেন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে দেশ। টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এই ১৪ বছরে বাংলাদেশের অকল্পনীয় উন্নয়ন-অগ্রগতি হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র। উন্নত দেশের কাছেও বাংলাদেশ এখন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রগতি দেখে বিস্মিত। বিশেষ করে যোগাযোগ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে সরকার। অন্যান্য জেলার ন্যায় মুরাদনগর উপজেলার অধিকাংশ গ্রামের রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হলেও অবকাঠামোগত তেমন উন্নয়ন হয়নি লক্ষীপুর গ্রামের। যা আমাকে হতাশ করেছে। সাত বছর পর প্রিয় জন্মভূমিতে পা রেখে সড়কর এমন করুণ অবস্থা দেখতে হবে তা প্রত্যাশা করিনি। আমার বাপ-দাদার আমলে গ্রামের যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল, সাত বছর আগে প্রকৃতির যে রূপ আমি দেখেছি, সাত বছর পরও পরিবেশ তার রূপ আঁকড়ে ধরে রেখেছে। ফলে এখনো  সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়া যায় কবিতায়। শুধু পারি না, উচ্চস্বরে সামাজিক উন্নয়নের কথা বলতে।
১৫ জুলাই আমার এক ভাতিজির বিয়ে। নাম জান্নাত। তাই বিয়ের দু’দিন আগেই বিয়ে বাড়ি পৌছালাম। গ্রামের নাম জাহাপুর। এটি জান্নাতের নানির বাড়ি। নানির বাড়িতেই বিয়ের আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কাজেই নিজ গ্রামে না গিয়ে, সরাসরি জাহাপুর চলে গেলাম। বলে রাখা ভালো, আমার গ্রাম ও জাহাপুর একই উপজেলায় অবস্থিত। পান্নারপুল থেকে জাহাপুর যেতে আমাদের অনেক গ্রাম অতিক্রম করে যেতে হয়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রাম হলো- ধামঘর, নল চমুহনী, ভাগলপুর, রায়তলা, পাইয়ব, শুশুন্ডা ও বাখরাবাদ। জাহাপুর পৌছানো পর্যন্ত প্রতিটি গ্রামের অকল্পনীয় উন্নয়নে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। সাত বছর আগে গ্রাম ছেড়ে যখন শহরে পাড়ি জমাই; তখনকার সড়ক, আর বর্তমান সড়কে আকাশ-পাতাল সার্থক্য। এই সাত বছরে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সিএনজিতে বসে মনে হচ্ছিল প্লেনে চড়ছি। কোথাও কোন ঝাঁকুনি নেই। সমতল পিচঢালা রাস্তা। রাস্তাটি সোজা ইলিয়টগঞ্জ গিয়ে লেগেছে। এই রাস্তায় বাস চলাচল করে তাই হয়তো এত ভালো। কিন্তু না! এই মেইন রোড ছেড়ে যখন জাহাপুরের বাইলাইনে ঢুকলাম তখনও একই অবস্থা। রোড কিছুটা সরু, কিন্তু মান একই ; সমতল পিচঢালা রাস্তা। জাহাপুর একটি গ্রাম হলেও সড়ক দেখে বুঝার উপায় নেই এটি গ্রাম ; নতুন যেকেউ শহরই মনে করবে।
একই উপজেলায় দুইটি গ্রাম, অথচ কতো পার্থক্য! উপরের বা দিকের ছবি দেখে বোঝার উপায় নেই সড়ক নাকি চষা খেত। পা দিলেই হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ডেবে যায়! এক পা ঢুকিয়ে তো অন্য পা তুলে আবার ফেলতে লাগে কয়েক মিনিট। আর রিকশা বা ভ্যান পড়লে তো কথাই নেই, লেগে যায় কয়েক ঘন্টা। অন্যদিকে ডান পাশের ছবি দেখে কৃষি ক্ষেতের আইল মনে হলেও এটিই মূলত লক্ষীপুর গ্রামের প্রধান সড়ক। এই সড়কে আধ হাত যায়গাও রাখা হয়নি চলাচলের জন্য।এভাবেই চলছে লক্ষীপুর (১৯৯৯ জন) ও মুগসাইর (১৬০৪ জন) নামক দুটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষের জীবন। আর এসব কাঁচা ও সরু রাস্তাগুলোর জন্য বর্তমান সময়ে এসেও এলাকাবাসীর পড়তে হচ্ছে চরম দুর্ভোগে। বর্ষা মৌসুমে এ রাস্তায় পানি আর নরম মাটিতে লোকজনের হাঁটা চলায় চারিদিকে কাঁদায় একাকার হয়ে যায়। গ্রামে বিকল্প কোন রাস্তার ব্যবস্থা না থাকায় হাটু সমান কাঁদা মাড়িয়ে চলাচল করতে হয় এখানকার স্কুল কলেজের ছাত্র- ছাত্রী ও বয়োবৃদ্ধসহ সকল শ্রেণি পেশার নাগরিকদের। শুধু তাই নয়, প্রশস্ত রাস্তা না থাকায় এ গ্রামে কোন যানবাহন চলাচল করে না। ফলে হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে কিংবা স্টোক এর মতো ভয়াবহ ব্যাধির সম্মূখীন হলে তাকে হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হয় না। অশ্রুসিক্ত নয়নে অকাল মৃত্যুর সাক্ষি হতে হয়। এভাবেই স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত এ গ্রামের মানুষ। এ গ্রামে লক্ষীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, নেই নিজস্ব কোন বাজারও। তাই নিত্যদিনের বাজার ও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে পায়ে হেটে অন্যগ্রামে যেতে হয়। উন্নত সড়ক ব্যবস্থা না থাকায় সাইকেল চালিয়ে পথ অতিক্রম করাও দুঃস্বপ্নের মতো। অন্যদিকে এলাকার মানুষের শিক্ষা, বাজার ও ব্যবসা-বাণিজ্য দারোরা কেন্দ্রিক হওয়ায় প্রচণ্ড এ কাঁদায় চলতে গিয়ে অনেকেই পা পিছলে পড়ে গিয়ে গন্তব্যে যাবার আগেই বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হন। শিক্ষার্থীরা সময় মতো স্কুল-কলেজে যেতে পারে না। তাই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত এলাকার লোকজন।গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তির আশায় বছরের পর বছর সংসদ সদস্য, চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় মেম্বারের কাছে আবেদন জানালেও সড়কের কোনো উন্নয়ন হয়নি। তাই এই সড়ক নিয়ে আমি যেন সংবাদ প্রকাশ করি গ্রামবাসী বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন। আমার সফর সঙ্গী সাংবাদিক আরফাত সিদ্দিকীও তাদের মতামতে সম্মতি প্রকাশ করলেন।
একই উপজেলার অন্য গ্রামে পাকা সড়ক আর লক্ষীপুর গ্রামের পিছিয়ে পড়া আসলেই লজ্জাজনক। মহান মুক্তিযুদ্ধে যে গ্রামের মানুষের অবদান অনেক বেশি, সে গ্রাম আজ অবহেলিত এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নে ভুগছে। এ যেন এক জনপ্রতিনিধিহীন গ্রাম। অথচ এসব প্রতিনিধিরা জানে না, এ গ্রামের মানুষের সাহসিকতা ও বীরত্বে পাকিস্তানি বাহিনী এ গ্রামে প্রবেশের খুব একটা সুযোগ পায়নি।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই সময়ে পাতিনেতাও বড় নেতা সাজবে। নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেকেই হয়তো নানা প্রতিশ্রুতি দিবে। যেমনটা আগে অনেকেই দিয়েছে। কিন্তু কোন নেতাই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। অন্যদিকে আমজনতা ঠিকই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। তবে সুফলটা আর ভোটাররা পায়নি। তবে এবার আমরা প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তবায়ন চাই। যেহেতু লক্ষীপুর গ্রামের প্রধান সড়ক দু’টি গ্রামের মানুষের চলাচলে জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে রাস্তাগুলো পাকা করণে সংসদ সদস্য ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন এমপিসহ জনপ্রতিনিধিদের সুদৃষ্টি কামনা করেছি।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |